শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০৩ অপরাহ্ন
জিনাত আরা আহমেদ মা-বাবার চোখের মনি পারুল। দিন দিন পারুল খুব চঞ্চল হয়ে উঠছে। কখন কোথায় যায় সারাক্ষণ চোখে চোখে রেখেও সামলানো দায়। পারুলের বাবা সোহেল বাড়ীতে থাকলে পারুলকে নজরে রাখে, তখন পারুলের মা জেসমিনের কাজে একটু সাহায্য হয়। সকালের খাবার খেয়ে সোহেল বেরিয়ে গেলে জেসমিন পারুলকে খাবার দিয়ে বসিয়ে ভাবে, ও খেতে থাকুক-এ সুযোগে ক্ষেত থেকে কয়েকটা টমেটো তুলে আনি, রান্নার সময় কাজে দেবে। কিছুক্ষণ পর জেসমিন ফিরে এসে দেখে পারুলের খাবার পড়ে আছে কিন্তু ও নেই, জেসমিন চমকে ওঠে। এদিক-ওদিক খুঁজতে গিয়ে কোথাও না পেয়ে প্রতিবেশীদের সহায়তায় আশেপাশে খোঁজাখুঁজি করতে থাকে। এ সময় বাড়ীর পাশের ডোবায় পারুলকে ভাসতে দেখে সংজ্ঞা হারায় জেসমিন।
পানিতে ডোবার এমনি ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে আমাদের দেশের হাজার হাজার শিশু। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে প্রতি বছর পানিতে ডুবে মারা যায় ১০ হাজারের বেশী শিশু, যাদের বেশীর ভাগেরই বয়স পাঁচ বছরের কম। বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর কমপক্ষে ৩ লক্ষ ২২ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। পানিতে ডুবে মৃত্যুর ৪০ শতাংশের বয়স ১৫ বছরের কম। আর এদের মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে। পানিতে ডোবা ও অসুস্থতার পরিস্থিতি নির্ণয়ের (অর্থাৎ মনিটরিংয়ের) জন্য সরকার হেলথ এন্ড ইনজুরি নামে একটি সার্ভে পরিচালনা করে। এই সার্ভে থেকে জানা যায়, প্রতি বছর প্রায় ১৭ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। তার মধ্যে চারগুণ অর্থাৎ প্রায় ৬৮ হাজার শিশু পানিতে ডুবে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর ও জলাবেষ্টিত আমাদের বাংলাদেশ। এ অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি বন্যাপ্রবণ। বছরের নির্দিষ্ট সময় বর্ষার আধিক্য থাকায় বহু স্থানে পানি জমে থাকে। শুধু তাই না, গ্রামে ঘরের আশেপাশে পুকুর কিংবা ডোবা থাকাটা খুবই সাধারণ দৃশ্য আমাদের দেশে। দূরে কোথাও যাতায়াতে নদী অথবা খাল পার হয়ে যেতে হয়। এসব ক্ষেত্রে সাঁতার না জানাটা মারাত্মক ঝুঁকি।
ঝড়-বৃষ্টির দিনে প্রতিবছরই নৌ-দুর্ঘনায় প্রাণহানি ঘটতে দেখা যায়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রাণহানির পাশাপাশি বাড়ীর আশেপাশে ডোবা, নালা, পুকুর-জলাশয়ে শিশুদের মৃত্যু অধিকতর উদ্বেগজনক। এর প্রধান কারণ হলো-এসব শিশুরা সাঁতার জানে না। গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামে সকাল ৯টা থেকে ১টা পর্যন্ত সময়ে অধিকাংশ শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। সাধারণত এ সময়টাতে বাবা বাড়ীর বাইরে থাকেন। মায়েরা সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকেন। অন্য ভাই-বোনেরা স্কুলে কিংবা খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকে। ফলে সবার অগোচরে শিশু পুকুর কিংবা জলের ধারে খেলতে গিয়ে পড়ে যায়। সাঁতার না জানার কারণে ওরা ডুবে যায়। বর্তমানে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলেও পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। যেমন- বাসার আশেপাশে ড্রেন কিংবা ম্যানহোলে শিশু পড়ে যাওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়।
সাধারণত গ্রামের বেশীরভাগ শিশু মায়ের সাথে পাশের পুকুরে কিংবা নদীর ঘাটে গোসলে গিয়ে ছোট থেকেই পানিতে ভেসে থাকার কৌশল শিখে যায়। শৈশবে শিশুর শরীরের ওজন কম থাকায় এ সময় তার জন্য ভেসে থাকাটা সহজ হয়। তাছাড়া অভ্যস্ত হওয়ায় ওদের মধ্যে পানির প্রতি ভীতিবোধ থাকে না। ফলে ছোট থেকেই গ্রামের সাঁতার জানা শিশুরা দলবেঁধে পানিতে নেমে নির্মল আনন্দ উপভোগ করে। তবে এমন দৃশ্য আগে যতটা দেখা যেতো, এখন ততোটা নয়। শহরে তো এমন দৃশ্য ভাবাই যায় না।
শহরে শিশুরা এ সুযোগ পায় না কারণ বড় বড় শহরে পুকুর খুব কম থাকে, আর থাকলেও তাতে ময়লা-আবর্জনার ভয়ে কেউ বাচ্চাকে নামাতে সাহস পায় না। স্কুলে পড়াশোনার চাপে শিশুরা সারা বছরই ব্যস্ত থাকে। এ ক্ষেত্রে যে সকল মা-বাবা বছরের নির্দিষ্ট সময় গ্রামের বাড়ীতে বেড়াতে যাওয়ার সুযোগে যখন বাচ্চাদের পুকুরে নামাতে কিংবা সাঁতারের জন্য উদ্যোগ নিতে যান, তত দিনে শিশুর মাঝে জলভীতি শুরু হয়। আবার দশ বছর থেকে ওজন বাড়তে থাকার কারণে ভেসে থাকার জন্য যে পরিশ্রম করতে হয়, অনেক শিশুই তা করতে পারে না। এ কারণে দেশের বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশ শিশুই সাঁতার জানে না।
পানি নির্মল আনন্দের উৎস। পানির সৌন্দর্য যেমন প্রত্যেককে বিমোহিত করে তেমনি পানিতে নামার আনন্দ বর্ণনাতীত। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষকে যাত্রাপথে পানি অতিক্রম করতে হয়। যিনি সাঁতার জানেন না, তার জন্য এই যাত্রাপথ পুরোপুরি আনন্দের হয় না বরং তার মনে সবসময় পানিতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাদের নিয়ে আবার দূরে কোথাও গেলেও বাবা-মায়েরা তাদের নিয়ে সবসময় শঙ্কায় থাকেন। পানিভীতি যেন সবার মনকে দুর্বল করে রাখে। কিন্তু অভিভাবকদের মনে রাখা দরকার, পানিতে ভেসে থাকার কৌশলটি শেখা জীবনের অন্যতম জরুরী কাজগুলির একটি।
আমরা অনেকেই মনে করি বাচ্চাদের লেখাপড়ার সময় অন্য কিছু করলে সময় নষ্ট হয়। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য পানিতে ভেসে থাকার কৌশল জানা পড়ালেখার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। গ্রীষ্মে যখন পুকুরে পানি কম থাকে, সেই সময় ছুটি নিয়ে বাচ্চাদের সাঁতার শেখাতে গ্রামের বাড়ী গেলে ওরা খুব অল্প সময়েই সাঁতার শিখে যায়। পুকুরে নেমে প্রতিদিন একটু একটু করে চেষ্টা করলে আপনা থেকেই শিশুরা ভেসে থাকার কৌশল শিখে যায় এবং এতে তারা অপার আনন্দ পায়। তবে পানিতে থাকাকালীন সবসময়ই শিশুদের সাথে বড়দের থাকা আবশ্যিক।
যে কোন কাজ আনন্দের সাথে শিখলে তাতে সময়ও কম লাগে। প্রতিটি অভিভাবকেরই উচিত শিক্ষার প্রথম পর্যায়েই শিশুকে সাঁতার শেখানো। শহরে পুকুর নদী-নালার অভাব থাকায় সব শহরে সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা প্রয়োজন। স্কুলের শিশুদের বাধ্যতামূলকভাবে সাঁতার শিখতে শিক্ষকদের উচিত উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচী পরিচালনা করা। ক্রীড়া সংস্থার মাধ্যমে প্রতিটি জেলা ও উপজেলাতে শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হাত থেকে তাদের জন্য ঝুঁকিমুক্ত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা সম্ভব হবে -পিআইডি ফিচার।
Leave a Reply