সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:০০ পূর্বাহ্ন
॥শিহাবুর রহমান॥ আমার পুরো পৃথিবী ছিল আমার আম্মু। আম্মুর সঙ্গে আমি প্রতিদিন ফোনে কয়েকবার করে কথা বলতাম। আমার আব্বু ও আম্মুর মধ্যে অনেক সুসম্পর্ক ছিল। রান্না থেকে শুরু করে বাড়ির বিভিন্ন কাজে আব্বু আমার আম্মুকে সাহায্য করতো। বরং আমার মামা ও খালারা লোভী বলে তাদের সঙ্গে আম্মুর সম্পর্ক ভালো ছিল না। আমার আব্বুকে যে অভিযোগে মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছে সে অভিযোগের কিঞ্চিত পরিমাণও যদি সত্যি হতো তাহলে আমি নিজেই আমার আব্বুর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতাম।
এ কথাগুলো সাংবাদিকদের বলেন স্ত্রী আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে কারাগারে আটক রাজবাড়ী সদর উপজেলার কোলা সদর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফরহাদ বিশ^াসের মেডিকেল কলেজ পড়ুয়া মেয়ে মাইশা ফারজানা।
ফরিদপুর ডায়াবেটিক এসোসিয়েশন মেডিকেল কলেজের ছাত্রী মাইশা ফারজানা অবনী বলেন, ‘পারিবারিক কিছু বিষয় নিয়ে গত ৮ই এপ্রিল দিবাগত রাত ১০টার দিকে আমার আম্মু অভিমান করে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করে। তখন আমার আব্বু বাড়িতে ছিলেন না। আমার মামা ও খালারা আমার আব্বুর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে তাকে জেলে পাঠিয়েছে।
মাইশা বলেন, আমি নিজে মেডিকেলের শিক্ষার্থী। পুলিশের উপস্থিতিতে আমি আমার আম্মুর সুরতহাল করেছি। আমার আম্মু আত্মহত্যা করেছে। আমার আম্মু পৃথিবী থেকে চলে যাওয়াতে আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেছে। তারওপর আমার মামা ও খালারা আমার আব্বুকে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে পাঠিয়ে আমাকে ও আমার ছোট ভাইকে আরও হয়রানি করছে। আমরা মিথ্যা মামলা থেকে আমাদের আব্বুর নিঃশর্ত মুক্তি চাই।
ফরহাদ বিশ^াসের ছেলে অর্ণব বলেন, আমি ও বাবা বাড়িতে ইফতার করে বাইরে চলে যাই। রাতে আমার বোন আমাকে ফোন করে বলে যে আম্মু ওর ফোন ধরছেনা। তখন আমি বাইরে থেকে বাড়ি এসে আম্মুর ঘরের দরজা বন্ধ দেখে আম্মুকে ডাকাডাকি করি। অনেক ডাকাডাকির পরেও আম্মু দরজা না খোলায় আমি জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি আম্মু ফ্যানের সাথে ঝুলছে। সে সময় আমাদের বাড়ির পাশের মসজিদে তারাবীর নামাজ পড়ে মুসল্লিরা বাড়ি ফিরছিলেন। আমার চিৎকারে মুসল্লিরা ছুটে আসে। তাদের সহায়তায় ফ্যান থেকে আম্মুর লাশ নিচে নামানো হয়। তারপর আব্বুকে ফোন করা হলে তিনি দ্রুত বাড়িতে আসেন।
অর্ণব আরও বলেন, রাতে যখন আমাদের বাড়িতে পুলিশ আসে তখন আমার খালা লিমা আমাকে ডাক দিয়ে ফাঁকে নিয়ে যায়। সে সময় খালা আমাকে বলে আমি যেন পুলিশের কাছে বলি যে, আমার আব্বু আমার আম্মুকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেছে। তখন আমি আম্মুর জন্য অনেক কান্না করছিলাম। আমি খালাকে বলি যে ঠিক আছে আপনি যা বলেন তাই বলবো। পরে পুলিশ আমাকে জিজ্ঞাসা করলে আমি আমার খালার শিখিয়ে দেওয়া মিথ্যা কথা না বলে আমি যেভাবে আম্মুর লাশ ঝুলতে দেখেছি সেসব সত্যি কথা বলি। এরপর থেকেই আমার তিন খালা ও মামারা আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়। শুধু তাই নয় তারা আমার আব্বুর সাথে আমাকেও মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করে।
ফরহাদ বিশ্বাসের মা জহুরা বেগম বলেন, যেদিন পূরবী আত্মহত্যা করে সেদিন ফরহাদ ও পূরবী একসাথে বসে ইফতার করে। এরপর ফরহাদ বাইরে চলে যায়। পরে রাতে ফরহাদের ছেলে অর্ণব বাড়িতে এসে তার মাকে ডাকাডাকি করলে ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায়না। পরে অর্ণব ঘরের জানালা দিয়ে পূরবীকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পায়। এরপর দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে পূরবীর লাশ নিচে নামানো হয়। পূরবীর ভাই ও বোনরা আমার ছেলেকে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসিয়েছে। আমি আমার ছেলের মুক্তি চাই।
ফরহাদ বিশ্বাসের প্রতিবেশী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ফরহাদ বিশ্বাসকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি। তিনি খুব ভালো মানুষ। তিনি কোনদিনও তার স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যবহার করেননি। বরং তার স্ত্রীর জিদ বেশি ছিল। স্বামী-স্ত্রী টুকিটাকি কোন কথা কাটাকাটি লাগলেই তার স্ত্রী উত্তেজিত হয়ে যেত। ফরহাদ বিশ্বাস তার স্ত্রীকে হত্যা করবেন এটা আমরা এলাকাবাসী বিশ্বাস করিনা। হয়তো সাধারণ কোন কথা নিয়েই তার স্ত্রী জিদ করে আত্মহত্যা করতে পারেন।
কোলা সদর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক আব্দুল করিম সরদার বলেন, এই স্কুলটি ফরহাদ বিশ্বাসের বাবার প্রতিষ্ঠিত। ১৯৯৫ সালে এই স্কুলে ফরহাদ বিশ্বাসের চাকুরী হয়। ২০১২ সালে তিনি প্রধান শিক্ষক হন। স্কুলে যোগদানের পর থেকেই তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে স্কুলটির উন্নয়নমূলক কাজ করে আসছেন। তার স্ত্রীও আমাদের পাশের স্কুলেরই শিক্ষক। তার স্ত্রীকেও আমরা চিনি। ফরহাদ বিশ্বাস ও তার স্ত্রী পূরবী ইসলামের মধ্যে অত্যন্ত সুসম্পর্ক আমরা দেখেছি। সবসময় তারা দু’জন হাসিখুশি থাকতেন। পূরবী ইসলামের মৃত্যুর পর তার ভাই-বোনেরা ফরহাদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে পরকীয়ার মিথ্যা অভিযোগ তুলেছে। আমরা খুব কাছ থেকে ফরহাদ বিশ্বাসকে চিনি। তিনি পরকীয়ায় লিপ্ত হবার মতো মানুষ না। স্কুলের কোন শিক্ষক-শিক্ষার্থী বা এলাকার একজন মানুষও ফরহাদ বিশ্বাসের চরিত্রের কোন দোষ দিতে পারবেন না। তার মতো একজন আদর্শ শিক্ষককে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে।
যে শিক্ষিকার সঙ্গে ফরহাদ বিশ্বাসের পরকীয়া সম্পর্কের অভিযোগ করা হয়েছে সেই শিক্ষিকা ছামিরুন নেছা বলেন, হেড স্যার ও তার স্ত্রীর সাথে আমাদের সকল শিক্ষকেরই সুসম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু আমাকে ও হেড স্যারকে নিয়ে যে নোংরা গুজব রটানো হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমার স্বামী-সন্তান রয়েছে, সুন্দর সাজানো সংসার রয়েছে। আমি কেন পরকীয়া করবো। আমি নামাজ-রোজা করি, দ্বীনের পথে চলি। কেন আমাকে জড়িয়ে এই মিথ্যা গুজব রটানো হচ্ছে আমি নিজেও জানিনা। আমি সাংবাদিক ভাইদের মাধ্যমে ঘৃনাভরে এই মিথ্যা গুজবের প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
ফরহাদ বিশ^াসের প্রতিবেশী মূলঘর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওহিদুজ্জামান বলেন, ফরহাদ বিশ^াসের স্ত্রী পূরবী ইসলাম খুব জিদি প্রকৃতির ছিল। কারণে অকারণে সে তার স্বামীকে সন্দেহ করতো। ফরহাদ বিশ^াস প্রায়ই তার স্ত্রীর দ্বারা লাঞ্ছিত হতো। ফরহাদ বিশ^াস সব কিছু আমার কাছে বলতো। এ নিয়ে আমি কয়েকবার তাদের মধ্যে সমোঝতা করে দিয়েছি। তবে সেগুলো কোন পরকীয়ার বিষয় ছিল না। তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর পূরবীর বোনেরা ফরহাদ বিশ^াসের সাথে অন্য শিক্ষিকার যে পরকীয়ার অভিযোগ উঠিয়েছেন সেটা অসম্ভব। এটা সম্পন্ন মিথ্যা।
প্রসঙ্গত, গত ৯ই এপ্রিল ভোরে রাজবাড়ী সদর উপজেলার কোলা গ্রামে স্বামীর বাড়ি থেকে কোলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পূরবী ইসলামের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তার মৃত্যু নিয়ে উভয় পরিবারে ভিন্নমত দেখা দেয়। পূরবীর ছেলে ও মেয়েসহ স্বামীর পরিবারের লোকজন বলছে, তিনি অভিমান করে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু পূরবীর তিন বোনের দাবি, পরকীয়ায় বাঁধা দেয়ায় তাদের বোনকে নির্যাতনের পর গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করেছে বোনের স্বামী ফরহাদ বিশ্বাস ও ছেলে অর্ণব।
অন্যদিকে, পূরবীর ভাই মেহেদী হাসান আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ এনে বোনের স্বামী কোলা সদর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফরহাদ বিশ্বাসকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করেছে। মামলায় ফরহাদ বিশ্বাস পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে জেলা কারাগারে রয়েছে।
এলাকাবাসী ও শিক্ষকবৃন্দ নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সহকারী শিক্ষক পূরবী ইসলামের আত্মহননের রহস্য উদঘাটনের দাবী জানিয়েছেন।
Leave a Reply